ডেথ সার্টিফিকেট

আবু মোশাররফ রাসেল ◑

প্রথম নির্বাচন করলাম, আর তাতেই জয়ী হয়ে গেলাম। এত কম বয়সের একজন প্রার্থীকে এলাকার বাসিন্দারা এত বিপুল ভোট দিয়ে কেন ‘সর্বকনিষ্ঠ কাউন্সিলর’ নির্বাচিত করেছেন তা নিজেই বুঝে উঠতে পারি না। কী এমন করেছি আমি কিংবা আমার চরিত্রের কী এমন ভালো দিক আছে যে ভোটাররা এভাবে আমাকে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ভোট দিল? হিসাব মেলাতে গেলে আব্বার একটি উপদেষই কেবল কেবল খুঁজে পাই। রাজনীতি নিয়ে যখন মাথা ঘামানো শুরু করছিলাম, আব্বা অন্য সব অভিভাবকের মত বর্তমান ‘নোংরা রাজনীতির’ ভয়ে আমাকে তা থেকে বিরত থাকতে বারণ করেননি। তিনি একটা উপদেষ দিলেন—‌‌‘শুধু রাজনীতিই নয়, সারাজীবনই একটা কথা মনে রাখিস, মুরুব্বীদের কখনো অসম্মান করবি না, নিজেকে কখনো জাহির করতে যাবি না-তাহলে মানুষ তোকে ঠিকই মূল্যায়ন করবে।’ আব্বার এই উপদেষটুকু আমি এই বয়স পর্যন্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি, ভবিষ্যতেও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটানোর ইচ্ছে নেই। সম্ভবত, এর কোনো প্রভাব ভোটে পড়েছে।

ওয়ার্ড কার্যালয়ে সেই সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত খাটুনি। আমাদের কাছে কত শত কাজ দিয়ে রেখেছে সরকার। সালিশ-বিচার তো আছেই, নাগরিকত্ব সনদ, জন্মসনদ, মৃত্যুসনদ, ওয়ারিশ সনদ—‌‌আরও কত কি। এসব নিয়েই দিনভর ব্যস্ততা। এসব কাজের জন্য কত বিচিত্র ধরনের মানুষ যে প্রতিদিন দেখি তার ইয়ত্তা নেই। আমি অবশ্য কাজটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি, এটাই আমার ক্যারিয়ারের ‘টার্নিং পয়েন্ট’। সুতরাং মনে মনে একটা পণ করেছি যে আমার ওয়ার্ডে এসে কোনো নাগরিক যেন সেবাবঞ্চিত না হন। যেহেতু অল্প বয়সেই মানুষ আমাকে একটা প্রত্যাশা নিয়ে নির্বাচিত করেছেন, সুতরাং তাদের ‘যোগ্য প্রতিদান’ আমাকে দিতেই হবে—‌‌সে যত পরিশ্রমই হোক। কাউন্সিলর হিসেবে নিজের কাজটিতে কখনো কখনো রোমাঞ্চিত হই, কখনো কখনো ব্যথিতও হই। এই যেমন এলাকার একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী, সেও যদি এসে জাতীয়তা সনদ চায় ভোটের খাতিরে তাকেও সমাদর করতে হয়। যে সনদে লেখা থাকে ‘তাহার স্বভাব চরিত্র অত্যন্ত ভালো, তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত নয়’; লোকটা খারাপ জেনেও এ প্রত্যয়নে স্বাক্ষরটা দিতে হয়।

একবিন্দু অবসরে এসব ভাবছিলাম আর ফোনটা বেজে উঠলো। শায়লার ফোন। রিসিভ করতেই সিরিয়াস এক প্রশ্ন—‌‌‘হ্যালো, মোরশেদ একটা কথা বল তো, আমি তোমার ‘সম্পত্তি’ নাকি ‘সম্পদ’? আমি বলি, কাজের মাঝে এসব প্যাঁচাল করো না তো, কী বলতে চাও সোজাসুজিই বল। সম্পত্তি আর সম্পদ তো একই ব্যাপার। আমার উত্তরে শায়লা রেগে যায়, ‘না বুঝে কথা বলবা না, পড়ালেখা তো সব মাথা থেকে ঝেড়ে বিদায় দিয়েছ বুঝি, দুটি একই ব্যাপার হবে কেন? ভেবেচিন্তে কথা বল।

প্রতিদিনের বিচিত্র কাজের ভুবন থেকে আমাকে মাঝে মাঝে অল্প সময়ের জন্য অন্যভুবনে নিয়ে যায় আমার হবু স্ত্রী বা প্রেমিকা শায়লা শারমিন। সে আমার তৃতীয় প্রেমিকা, তাকে এভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কারণটা বলি—‌‌ওর স্বভাবটা গড়পড়তা মেয়েদের তুলনায় ‘ভিন্ন ধরনের’। এর আগে যে দুটি মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল তারা যেখানে প্রতিদিন ফোন করে, কোথায় বেড়াতে যাব, কী কী খাওয়া বাকি কিংবা বিয়েটা ঠিক কখন হবে এসব বিষয় নিয়ে ভাবত, শায়লা তা থেকে একদমই দূরে। ওই ‘ছোটখাট’ ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই, সব সময় তাত্ত্বিক ব্যাপার-স্যাপার, কথায় কথায় কোনো ভুল বললে কিংবা করলে তা ধরা আর সংশোধন করে দেওয়া নিয়েই তার যত ব্যস্ততা। প্রচণ্ড জেদিও মেয়েটা। ব্যক্তিত্ববান মেয়েরা জেদি হয়। আমি সম্পর্ক রক্ষার খাতিরে ব্যস্ততার মাঝেও বাধ্য হয়ে তার সাথে যতক্ষণ কথা বলি, সে সময়টুকুকে একটু মনটাকে হাল্কা করার ব্যাপার হিসেবে নিই, সে কারণে ও রাগ দেখালেও আমি হেসে উড়িয়ে দিই। কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকে আবেগের ব্যাপারগুলোও অবশ্য কমছে।

‘সম্পত্তি’ আর ‘সম্পদের’ মধ্যে কী পার্থক্য আর শায়লা আমার কাছে এ দুটির কোনটি—‌‌এই উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত সে ফোন রাখবে না। শায়লা বললো, ব্যাপারটা যে কী সেটা তুমি ভালোই জানো, হয়তো বলতে চাইছো না অথবা ভুলে গেছ। আমি বললাম, একটু সূত্র ধরিয়ে দাও তো, মনে করার চেষ্টা করি। ও বলল, ওই যে রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’। মনে পড়ে গেল। হৈমকে নিয়ে অপুর সেই উক্তি—‌‌‘সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ’। আসলেই তো সম্পত্তি আর সম্পদের মধ্যে যে পার্থক্য আছে সেটা শিখেছি বহু আগে। সোজা হিসেবে সম্পত্তি হলো—‌‌ভোগের বিষয়, নিজের অধিকারভুক্ত স্থাবর সম্পত্তি, টাকা-পয়সা, জায়গা-জমি ইত্যাদি; যা মানুষ ভোগ করে আর একদিন ফুরিয়ে যায়। কিন্তু ‘সম্পদ’ হলো জীবনের পরিপূরক বিষয়, পরিপূর্ণতার ব্যাপার; যা কখনো ফুরিয়ে যায় না। সুতরাং এই সংজ্ঞা মনে পড়া মাত্রই শায়লাকে ঠিক অপুর মতোই বলে দিলাম, ‘তুমি আমার সম্পদ।’

দুজনের আলাপ শেষ না হতেই হঠাৎ কানে ভেসে এল কান্নার শব্দ। আঠারো-বিশ বছরের এক তরুণ কাঁদতে কাঁদতে ওয়ার্ডে অফিসে ঢুকছে। শায়লার ফোন কেটে দিলাম। জিজ্ঞ্যেস করলাম, কী ব্যাপার, কাঁদছ কেন? ছেলেটা বললো, তার বাবা মারা গেছেন, সে এসেছে একটা ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য। বাবার জন্য কাঁদছেন। আমি তাকে সহানুভূতি জানালাম। বললাম, একদিন সবাইকেই এই ধরাধাম ছেড়ে চলে যেতে হবে, আমরা কেউই এখানে থাকতে পারবো না। ছেলেটার কান্না থামে না, অস্থির কান্না। ওর অবস্থা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল, পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মানুষের চলে যাওয়াটা বড়ই বেদনার। এ রকম পরিস্থিতিতে আমার ঠিক কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারি না। ছেলেটিকে জিজ্ঞ্যেস করলাম, তোমার বাবার কি রোগ হয়েছিল? জবাব এল, ‘বার্ধক্য’। বার্ধক্য বলে তো কোনো রোগ নেই। শায়লার কিছু ব্যাপার আমার মাঝেও সংক্রমিত হয়েছে এতদিনে। তাই ছেলেটাকে শুধরে দিই—‌‌বার্ধক্য কোনো রোগ নয়, বয়স বাড়তে বাড়তে মানুষের শরীরের নানা ধরনের রোগ বাসা বাঁধে, ওসবকে বার্ধক্যজনিত রোগ বলে। এর মধ্যে ডায়াবেটিস আর উচ্চ রক্তচাপই হচ্ছে মারাত্মক। তোমার বাবার কি ডায়াবেটিস ছিল? আমার কথায় শাফায়েতকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখাল, তবে উত্তর দিল-হ্যাঁ। দ্রæত তার বাবার ‘মৃত্যু সনদ’ বা ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করে দেওয়া হলো, সার্টিফিকেটটি হাতে নিয়ে সে আবারও কান্নাজুড়ে দিল।
এর সপ্তাহখানেক পর শাফায়েত হোসেন আবারও ওয়ার্ড কার্যালয়ে এল, এবার তাকে বেশ স্বাভাবিক এবং সাহসী ভঙ্গিতে দেখছি। কুশল বিনিময়ের পর বলল, লিডার আপনাকে ধন্যবাদ। একটা ‘ওয়ারিশ সনদের’ জন্য এলাম। বাবা মারা গেছেন, জমি-জমা সম্পত্তিগুলো ভাই-বোনদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করতে হবে। আমি তাকে বেশ সমাদর করলাম, পিতৃহারা এতিম সন্তান তো। ‌দ্রুত ওয়ারিশ সনদ তৈরি করে দেওয়া হলো।

২.
জনপ্রতিনিধি হওয়ার মাঝে কিছু চমৎকার ব্যাপার আছে। ভোটারদের খুশি রাখতে প্রতিদিন কত ধরনের অভিনয় যে করতে হয়। এর মধ্যে একটি হলো সামাজিক অনুষ্ঠান। বিয়েশাদি, সন্তানের আকিকা, বাবা-মায়ের জেয়াফতের মেজবান সবকিছুতেই মানুষ কাউন্সিলরকে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে দাওয়াত দেন। কাউন্সিলর উপস্থিত হওয়া মানে সমাজের কাছে তাদের পরিবারের মর্যাদা অনেক বেড়ে যাওয়া, কাউন্সিলর না গেলে সেসব আয়োজনের যেন কোনো মানেই হয় না। আর জনগণের মনরক্ষা কিংবা ভোটের ভবিষ্যৎ চিন্তায় দিনে দশ-বারটি অনুষ্ঠানে-আয়োজনেও যেতে হয়, কতটাতে আর খেতে পারি। কোনটিতে খাই, কোনোটিতে খাওয়ার অভিনয় করতে হয়।

সেদিন এক বিয়ে অনুষ্ঠানে হাজিরা দিতে গিয়েছি। কারণ, এর আগে আরও দুটি অনুষ্ঠানে খেতে হয়েছে। তৃতীয়টিতে তাই খেতে পারছি না। স্টেজে উঠে বরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ছবি তুলে নেমে যাচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময়ে একজন বয়স্ক ব্যক্তি, ‘মোরশেদ, ওহ মোরশেদ’ বলে সামনে এসে দাঁড়ালেন। সফেদ চুল-দাড়িওয়ালা এই বৃদ্ধের বয়স বেশি হলেও মনেপ্রাণে বেশ সতেজ। আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, ‘বাবা, তুমি তো কাউন্সিলর মোরশেদ, তাই না?’ আমি উত্তর দিলাম, জি চাচা। আপনি ভালো আছেন, কিছু বলবেন আমাকে?
লোকটি তার পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে কিছু একটা বের করতে করতে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, আমি অনেকদিন ধরে তোমাকে খুঁজছি, পকেটে নিয়ে রেখেছি। তুমি কাউন্সিলর মানুষ, এত বড় কাজ করতে পারলা? আমি বেঁচে থাকতেই আমার ‘মৃত্যুসনদ’ দিয়ে দিলে? আমি তো মরিনি রে বাবা! বলতে বলতে লোকটি পকেট থেকে একটি ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ বের করে আমার হাতে দিলেন। আমি তো থ বনে গেলাম। আমার স্বাক্ষর করা সার্টিফিকেটে যে লোকটি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে মাস খানেক আগে, তিনি আমার সামনে। এই কাজটি কেমনে হলো? এই সার্টিফিকেট কে নিয়েছে, কেন নিয়েছে। এখন সেটি তারই বা হাতে কিভাবে এল? আমার বিচলিত হওয়া দেখে, বুড়ো মানুষটি বুঝলেন, এ ঘটনায় আমার দায় নেই। আমাকেও বø্যাকমেইল করা হয়েছে। তাই নিজেই বর্ণনা দিলেন—‌‌তারই কনিষ্ঠ সন্তান শাফায়েত সম্পত্তি আত্মসাতে জন্য বাবাকে মৃত দেখিয়ে কোর্টে হেবা দলিল সাবমিট করেছে! কোর্ট থেকে তদন্ত শুরুর পর বিষয়টি তিনি জানতে পারেন।
আমার চোখে ভেসে উঠল সেই ছেলেটির করুণ কান্নার দৃশ্য। কানে যেন এখনও ভেসে আসছে ওয়ার্ড অফিসে ‘বাবার শোকে’ শাফায়েতের সেই কান্না, কী নিখুঁত অভিনয়! তাও জন্মদাতা পিতাকে পৃথিবী থেকে বিদায় দেওয়ার মতো ঘটনা সাজিয়ে। মানুষ কেমনে পারে এসব?

পকেট থেকে ফোনটি বের করে শায়লাকে কল দিলাম—‌‌‘শোনো, তোমার ওই সম্পত্তি আর সম্পদের তত্ত¡ তো বদলে গেছে। মানুষের কাছে এখন সম্পদের চেয়ে সম্পত্তির মূল্যই বেশি।’ শায়লা বিচলিত হয়ে উঠে, কেন বলছ? ঘটনা খুলে বলার পর শায়লা, চুপ হয়ে থাকে। আমি রসিকতা শুরু করি, ‘এখন তো মনে হয় তোমাকে সম্পত্তিই বলতে হবে, শায়লা!’ সে কোনো উত্তর দিতে পারে না, সম্ভবত কি বলবে সেও ভেবে পায় না, কেবল রহস্যজনক একটি হাসি আমার কানে এসে মিলিয়ে যায়।